আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি; আজকের এই ব্লগে আমরা দেখতে চলেছি পশ্চিমবঙ্গ উচ্চ শিক্ষা পরিষদের অর্থাৎ WBCHSE Council এর দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সিলেবাস এর অন্তর্গত প্রথম অধ্যায় তথা অতীত ধারণা থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর; যা কিনা – আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি বলতে কী বোঝো? আধুনিক ইতিহাস রচনার উপাদান গুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। যেটা তোমাদের আগামী উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্নঃ আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি বলতে কী বোঝো? আধুনিক ইতিহাস রচনার উপাদান গুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উত্তরঃ ইতিহাস হল মানব সভ্যতার ধারাবাহিক বিবর্তন ও মানুষের অতীতকালের কর্মের ওপর গবেষণার ফল। মানব সমাজের উদ্ভব কয়েক লক্ষ বারটি বছর আগে এবং মানব সভ্যতার উদ্ভব কয়েক লক্ষ বছর আগে হলেও মানব সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাস লেখা শুরু হয় তার বহুকাল পরে। ইতিহাস হল গতিশীল সমাজবিজ্ঞান, তাই প্রায়ই ইতিহাস পুনর্লিখনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নতুন আবিষ্কার বানান ভাবধারার আলোকে অতীত ঘটনাবলী পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক যে যুগে বাস করেন সেই যুগের শিক্ষাগত ও সামাজিক মানদন্ডের প্রভাব তার লেখার ওপর সর্বদাই পড়তে দেখা যায়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- ঐতিহাসিক হেরোডোটাস মহাকাব্যের যুগের লোক ছিলেন, এজন্য তার লেখায় গল্প বলার ঝোক অনেক বেশি। মধ্যযুগে ধর্মের প্রভাব এত বেশি ছিল যে, সেন্ট অগাস্টিন গোটা বিশ্বকে ঈশ্বরের জনপদ বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে বিউরি আধুনিককালের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার যুগের লোক সেজন্য ইতিহাসকে বিজ্ঞান বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। কাজেই ইতিহাস যে যুগে রচিত হয়, সে যুগের ভাবধারা কে প্রকাশ করে। আধুনিককালে মূলত রেনেসাঁস পরবর্তী অধ্যায় ইতিহাস রচনায় পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। ইতিহাসের পরিধি বিস্তৃত এবং ইতিহাস রচনার পদ্ধতি হয়ে উঠেছে জটিল ও বিশ্লেষণমূলক।
আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি
আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি এক বিতর্কিত বিষয়। অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী ইতিহাস ও ঐতিহাসিক নাম সুবিখ্যাত গ্রন্থের মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে- ইতিহাস, বিশেষত সামগ্রিক ইতিহাস লেখা এক কঠিন বিষয়। কেননা ইতিহাস এমন এক বিপুল কর্মশালার বিষয় যার যবনিকা সরিয়ে একটুখানি কর্মকাণ্ড লক্ষ করেন ঐতিহাসিক। ডক্টর ত্রিপাঠি জানিয়েছেন, ইতিহাসের একটা বড় আকর্ষণের বিষয় হলো ঐতিহাসিকরা একই ঘটনা প্রবাহের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। এক্ষেত্রে তিনি মজা করে আগাথা ক্রিস্টির দা মুভিং ফিঙ্গার উপাখ্যানের এক কথোপকথনের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন এই উপাখ্যানে একটি ছোট মেয়ে তার অভিভাবক কে তার স্কুলের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অনুযোগের সুরে বলেছেন, স্কুলে এত রকমের বাজে জিনিস শেখানো হয়। এই অভিযোগের উত্তর অভিভাবক জানালেন, ওখানেই তো ইতিহাসের মজা, ইতিহাস লেখার এই মজা আধুনিককালে ইতিহাস লেখার অন্যতম আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে বটে।
ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অতীত ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদান এবং ইতিহাসবিদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যথার্থ ইতিহাস রচনার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এর উপস্থিতি একান্ত অপরিহার্য। ইতিহাস রচনার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান গুলি হল-
১) অতীতের রিপোর্টঃ
সভা ও সমাবেশের আলোচনার সংক্ষিপ্তসার ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলে এগুলি অসম্পূর্ণ প্রকৃতির এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থ নির্ধারণ অপেক্ষাকৃত কঠিন।
২) সার্ভে ও রিপোর্টঃ
সার্ভে রিপোর্ট গুলিকে ঐতিহাসিকরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে থেকে ইতিহাসের সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেন।
৩) ঘটনা পরম্পরার বিবরণ এবং ইতিহাসঃ
রক্ষিত এই জাতীয় পরম্পরা গুলি ব্যবহার করে ঐতিহাসিকেরা অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান তথ্য বের করে আনতে সক্ষম হয়েছেন।
৪) পারিবারিক ও ব্যক্তিগত উপাদানসমূহঃ
কোন ব্যক্তি বিশেষ কর্তৃক রচিত স্মৃতিকথা যা প্রকাশ করার উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত হয়েছিল সেগুলি যথাযথ বিশ্লেষণ থেকেও ঐতিহাসিক ইতিহাস রচনার উপাদান সংগ্রহ করতে পারেন বা করে থাকেন।
৫) রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সংকলিত দলিলঃ
রাজনৈতিক প্রচার পুস্তিকা, গ্রন্থ, ইশতেহার ইত্যাদি বিষয় ইতিহাস রচনায় ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ধর্মীয় প্রচারগুলো ইতিহাস রচনায় ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করে থাকে।
৬) সামাজিক প্রথা, লোকো কথা, পাঠ্যপুস্তক সমাজতাত্ত্বিক গবেষণাঃ
সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু ঐতিহাসিক তাদের গ্রন্থে লোকো কাহিনী এবং প্রথম কে ব্যবহার করে থাকেন। লোকগুলির সঠিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ থেকে নানান ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়।
৭) সংবাদপত্র, পত্র-পত্রিকা এবং জন সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য বিষয় সমুহঃ
সংবাদপত্র, কার্টুন, পোস্টার বিজ্ঞাপন ফিল্ম রেডিওতে ইত্যাদি বিষয় কেউ ঐতিহাসিকরা ব্যবহার করে থাকেন তাদের ইতিহাস রচনার জন্য। অতীতে নানা দিক গুলোকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এগুলি নিঃসন্দেহে সাহায্য করে থাকে, বিশেষ করে অতীতের আদর্শ ধ্যান-ধারণা মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জানতে হলে এই উপাদান গুলির ব্যবহার আবশ্যক।
৮) প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহঃ
এই জাতীয় উপাদান গুলি প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার করেন না কিন্তু তাহলেও অতীত সম্পর্কে জানার ব্যাপারে এগুলি তাদের নানান ভাবে সাহায্য করে থাকে। বিশেষ করে অতীতের পরিবেশ জীবনযাত্রা ইত্যাদি বিষয়ে জানার জন্য এই জাতীয় উপাদান গুলির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সাধারণত প্রাচীন যুগের ইতিহাস চর্চার জন্য এগুলি বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এজাতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের আবিষ্কার অনেক ক্ষেত্রেই প্রচলিত ব্যাখ্যাকে পরিবর্তিত করে দেয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যেতে পারে যে ভারতবর্ষের ইতিহাসে বৈদিক সভ্যতার প্রাচীনতম সভ্যতা বলে মনে করা হতো। কিন্তু হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার আবিষ্কার প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে প্রবর্তিত করে। কেননা এই আবিষ্কারের ফলে জানা যায় যে বৈদিক সভ্যতার আগে আরো উন্নত ধরনের নগর সভ্যতা ভারতবর্ষে গড়ে উঠেছিল।
৯) সাহিত্যিক ও অন্যান্য ধরনের শিল্পকলাঃ
এ বিষয়ে অবশ্য পন্ডিতমহলে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। যারা অভিলেখাগার এ দলিল গুলিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন তারা সাহিত্যকে ইতিহাসের তথ্য সূত্র হিসেবে ব্যবহারের পক্ষপাতী নন। কেননা তাদের বক্তব্য অনুযায়ী সাহিত্য কর্মের মধ্যে কল্পনার আধিক্য থাকায় সত্য নির্ণয় এর পক্ষে তার সহায়ক হয় না। কিন্তু ঐতিহাসিক ও সমাজতত্ত্ব বৃদ্ধের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা মনে করেন সাহিত্যকর্ম থেকে ইতিহাসের নানান তথ্য সংগৃহীত হতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক কে সাহিত্য তত্ত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হবে।
১০) মৌখিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যঃ
জনৈক ঐতিহাসিক মারউইক তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলির ক্ষেত্রে এই জাতীয় উপাদান কে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। তবে এই জাতীয় তথ্যগুলিকে ইতিহাস রচনায় কাজে ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট দক্ষতা ও জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। এই জাতীয় তথ্য সেইসব অঞ্চলের জন্য বিশেষ প্রয়োজন যেসব অঞ্চল এর ক্ষেত্রে লিখিত উপাদান বিশেষ নেই বললেই চলে।
উপসংহারঃ
আমাদের সমাজে নানা ঐতিহাসিক উৎস ও তথ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একমাত্র কোন ঐতিহাসিক উৎস ও তথ্য যাচাই করে এবং সুসংবদ্ধ পদ্ধতি ব্যবহার করে সে বিষয়ে যথার্থ ইতিহাস রচনার করতে পারেন। আধুনিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে উক্ত উপাদান গুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ঐতিহাসিক। কেননা তিনিই ঐতিহাসিক উৎস ও তথ্য যথার্থভাবে যাচাই করে এবং সুসংবদ্ধ পদ্ধতি ব্যবহার করে ইতিহাস রচনা করবেন।
আরো পড়ুন – পেশাদারী ইতিহাস বলতে কী বোঝো? পেশাদারী অপেশাদারী ইতিহাসের পার্থক্য আলোচনা করো?
বিঃ দ্রঃ আমাদের আজকের আর্ট স্কুল ইন ব্লগ-এর এই আর্টিকেলটি অর্থাৎ আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি বলতে কী বোঝো? আধুনিক ইতিহাস রচনার উপাদান গুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। প্রশ্নটির উত্তর তৈরি করার জন্য আমাদের কিছু পাঠ্যবই এবং রেফারেন্স বইয়ের সাহায্য নিতে হয়েছে। যদিও আমাদের তরফ থেকে কোনো প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি; তাই আজকে আমাদের এই আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি বলতে কী বোঝো? প্রশ্নটির উত্তরটি নিয়ে আপনাদের কারো যদি কোনরকম সমস্যা হয়ে থাকে বা অভিযোগ থেকে থাকে; তাহলে আমাদের ইমেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব আপনার সমস্যা দূরীকরণে। ধন্যবাদ।