Menu

আন্তর্জাতিক আইন কাকে বলে?

আন্তর্জাতিক আইন; পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা পরিষদ WBCHSE এর অন্তরর্গত একাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান সিলেবাসের চতুর্থ অধ্যায় আধুনিক রাজনীতির মৌলিক ধারনা সমূহ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্ন হল আন্তর্জাতিক আইন কাকে বলে?  আন্তর্জাতিক আইনকে কি আইন বলা যায়? যা তোমাদের আগামী পরিক্ষার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্নঃ আন্তর্জাতিক আইন কাকে বলেআন্তর্জাতিক আইনকে কি আইন বলা যায়?

উত্তরঃ আন্তর্জাতিক আইন- এই শব্দটি সর্বপ্রথম ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে জেরেমি বেন্থাম প্রয়োগ করেছিলেন। তবে তার আগে টমাস একুইনাস, হুগো, গ্রোটিয়াস আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন। পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক আইনের গুরুত্ব অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেলেও আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা নিয়ে আইনবিদদের মধ্যে যথেষ্ট মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে মূলত তিনটি বিভাগ উঠে আসে, যে গুলি হল- সনাতন সংজ্ঞা, আধুনিক সংজ্ঞা এবং মার্কসবাদী সংজ্ঞা।

আন্তর্জাতিক আইন কাকে বলে?  আন্তর্জাতিক আইনকে কি আইন বলা যায়?
আন্তর্জাতিক আইন কাকে বলে?  আন্তর্জাতিক আইনকে কি আইন বলা যায়?

লরেন্স, ফেনউইক, ব্রিয়ারলি প্রমূখ সংজ্ঞা প্রদান করেন।  তাদের মতানুযায়ী আন্তর্জাতিক আইন হলো- সেইসব আন্তর্জাতিক নিয়ম রীতিনীতি ও প্রথা সমষ্টি যেগুলি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র সমূহের আচার-আচরণ কে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।  আধুনিক সংজ্ঞা প্রদানকারীদের মধ্যে স্টার্ক অন্যতম।  তার মতে আন্তর্জাতিক আইন হলো সেই সব নিয়ম ও আচার-আচরণের নীতি যেগুলিকে রাষ্ট্রসমূহ পারস্পারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মেনে চলতে বাধ্য।  তবে মার্কসবাদীরা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তার মধ্যে শ্রেণীচরিত্র বিশিষ্ট রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মাবলীর সমষ্টিকে আন্তর্জাতিক আইন বলে অভিহিত করেছেন।

আন্তর্জাতিক আইন কে প্রকৃত অর্থে আইন বলা যায় কিনা?

আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত অর্থে আইন বলা যায় কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই বিষয়কে কেন্দ্র করে দুটি পরস্পর বিরোধী মত উঠে আসে,  সেই সঙ্গে এই দুটি মতের সমন্বয় ঘটিয়ে তৃতীয় একটি মতের সৃষ্টি হয়।

যারা আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত অর্থে আইন্না বলার পক্ষপাতী তাদের মধ্যে, অস্টিন, হলস, সলসবেরি হল্যান্ড প্রমূখ অন্যতম। তাদের মতে-

আইন হলো সার্বভৌমের কর্তৃপক্ষের আদেশ কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন কোন সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ বলে বিবেচিত হতে পারে না।

সাধারণত রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের জন্য একটি নির্দিষ্ট আইনসভা থাকে কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নের জন্য এমন কোন আইন সভার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয় না।

রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগ করার জন্য একটি বিভাগ থাকে মূলত শাসন বিভাগ এই আইনকে বলবৎ করে কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন বলবৎ করার জন্য এমন কোন আন্তর্জাতিক শাসন বিভাগের অস্তিত্ব নেই, ফলে এই আইনকে আইন বলা যায়না।

রাষ্ট্রের আইন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সকলকে মেনে চলতে হয়, না হলে তাকে শাস্তি পেতে হয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আইন মানতে কোন রাষ্ট্র অস্বীকার করলে তা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বলবৎ করা যায় না।

রাষ্ট্রীয় আইন ভঙ্গ করলে আদালত আইন ভঙ্গ কারি ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে পারে কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করলে তেমন শাস্তির কোন ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায় না।

রাষ্ট্রীয় আইন প্রকৃতিগতভাবে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হয়ে থাকে কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে এই দুটি বৈশিষ্ট্যের অনুপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।

আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম প্রধান দুর্বলতা হলো সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদের কয়েকটি ত্রুটিপূর্ণ ধারা যেমন ২২২/৭ নম্বর ধারার কথা বলা যায়। এই ধারা অনুযায়ী বলা হয় যে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জো কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না, ফলে এই ধারার সুযোগ নিয়ে অনেক রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনকে সঠিকভাবে মেনে চলে না। এই সমস্ত কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কোন আন্তর্জাতিক আইন মানতে অস্বীকার করেন।

আন্তর্জাতিক আইন এর পক্ষে যুক্তিঃ

হেনরিমেইন, লরেন্স, ব্রিয়ারলি,ফেনউইক,  প্রমূখ আন্তর্জাতিক আইনবিদ আন্তর্জাতিক আইনকে আইন বলে মনে করেন। আন্তর্জাতিক আইনকে আইন বলে মেনে নেয়ার পেছনে তারা যে যুক্তিগুলো প্রদান করেন, সেগুলি হল-

আন্তর্জাতিক আইনের উৎস সার্বভৌমের আদেশ নয়।  ভারতসহ সব দেশেই বহু প্রথাসিদ্ধ আইন প্রচলিত আছে যা সার্বভৌমের আদেশই নয়।  মানুষ এই সমস্ত আইন মেনে চলে স্বেচ্ছা সম্মতির কারণে রাষ্ট্রের ভয় নয়।  এই সমস্ত রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মতে তাত্ত্বিক দিক থেকে আইন হিসেবে পদবাচ্য হতে গেলে তিনটি গুণ বা শর্ত পূরণ করতে হয়,  যে গুলি হল-  কতগুলি নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন প্রয়োজন,  প্রয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে একটা সমাজ দরকার,  আইন কার্যকর করার ব্যবস্থা থাকা দরকার।  বলা বাহুল্য আন্তর্জাতিক আইনের এই তিনটি গুণ আছে।  যেমন-  আন্তর্জাতিক আইনের নানারকম নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন ও বিধি নিষেধ আছে,  বিশ্বসমাজ হলো আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ ক্ষেত্র এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং বিশ্ব জনমত থাকায় এই আইন কার্যকর করা সম্ভব,  সেই কারণে আন্তর্জাতিক আইনকে আইন পদবাচ্য হিসেবে গণ্য করা উচিত।

বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই আন্তর্জাতিক আইনকে শ্রদ্ধা এবং সমর্থন করে, কোন রাষ্ট্রেই ইচ্ছাকৃতভাবে এই আইন ভেঙে আন্তর্জাতিক সমাজ ও বিশ্বজনমতের নিন্দার পাত্র হতে চায়না।

আন্তর্জাতিক আইনের কোনো বৈধকর্তৃপক্ষ নেই বলে বিরুদ্ধবাদীরা প্রচার করেন, তা সঠিক নয়। কারণ বর্তমানে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের আন্তর্জাতিক আইনের একটি বৈধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বীকৃত।

বল প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আইন কে যেভাবে নাগরিকদের মানতে বাধ্য করা হয় আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয় বলে অনেকে এই রূপায়ন কে প্রকৃত অর্থে আইন বলে মেনে নিতে স্বীকার করেন না। কিন্তু বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সুদীর্ঘকাল কোন রাষ্ট্রীয় আইন কে যেমন বলবৎ রাখা যায় না তেমনি যেসব আইনের প্রতি জনগণের সমর্থন থাকে সেইসব আইন আপনা আপনি অতি সহজে বলবৎযোগ্য হয়ে ওঠে।  আইনের ক্ষেত্রে সে কথাই সমানভাবে প্রযোজ্য।

রাষ্ট্রীয় আইনের মতো আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট না হওয়ায় অনেকে এই রূপায়ন কে প্রকৃত আইনের মর্যাদা দিতে সম্মত হয় না। কিন্তু এই যুক্তি মেনে নেওয়া কঠিন কারণ দীর্ঘকাল ধরে আন্তর্জাতিক আইনকে সুসংবদ্ধ ভাবে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। উদাহরন হিসেবে আমরা 1856 সালে প্যারিস ঘোষণা, 1899, 1907 ও 1930 সালের হেগ  সম্মেলন, ১৯৪৭  সালের আন্তর্জাতিক আইন কমিশন গঠনের কথা আমরা বলতে পারি।

রাষ্ট্রীয় আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে যেমন দেশের আদালতে বিচার হয় তেমনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলি যে কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচারালয় অভিযোগ জানাতে পারে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিচারালয় অভিযোগ অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।

আন্তর্জাতিক আইন এর পক্ষে তৃতীয় মতামত

উপরিউক্ত দুটি মত এর পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় একটি মত উঠে আসে,  বলা হয় জাতীয় আইন এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনের পার্থক্য থাকলেও,  দেশের আইনকে সাধারণভাবে আইন বলে গণ্য করা যায়।  আধুনিককালে এই মতটি যথেষ্ট প্রাধান্য অর্জন করছে।  তৃতীয় মত অনুযায়ী ব্যাপক অর্থে আইন বলতে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ কে বোঝায় না।  তাছাড়া আইন কার্যকর কতটা হলো তার ওপর আইনের অস্তিত্ব নির্ভরশীল নয়।  আইনের তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন, এগুলি হল-  কতগুলি নিয়ম এর উপস্থিতি,  একটি সমাজের অস্তিত্ব এবং আইন কে কার্যকর করার উপযোগী  একটি সংস্থার উপস্থিতি।  এই তিনটি দিক থেকে বিচার করলে আন্তর্জাতিক আইনকে জাতীয় আইন এর মতই আইন বলে গণ্য করা যেতে পারে।

কারণ হিসেবে বলা হয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নানারকম বিধিনিষেধের অস্তিত্ব রয়েছে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে হিসেবে বিশ্বসমাজ রয়েছে যেখানে বিভিন্ন রাষ্ট্র সেই সমাজের সদস্য। এছাড়া আন্তর্জাতিক নিয়ম কার্যকর করার জন্য একটি প্রশাসনযন্ত্র দরকার তাও আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে রয়েছে,  যাকে আমরা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জো হিসেবে জেনে থাকি।  এই সমস্ত কারণে আন্তর্জাতিক আইনকে আইন বলে অনেকে মনে করে থাকেন।

উপসংহারঃ

আন্তর্জাতিক আইন,  আইন এই বৃদ্ধ বিতরকের পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে  এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে আন্তর্জাতিক আইন অবশ্যই আইনের মর্যাদা সম্পন্ন।  কারণ আইনের যেসব গুণ বা বৈশিষ্ট্য কিংবা উপযোগিতা থাকা প্রয়োজন তার সবগুলোই আন্তর্জাতিক আইনের রয়েছে।  এছাড়াও বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইন বিজ্ঞান আন্তর্জাতিক আইনের অনুকূলে ব্যাপক ও বলিষ্ঠ জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।  সম্মিলিত জাতিপুঞ্জো এবং আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের তত্ত্বাবধানে এই আইন ক্রমশ প্রকৃত আইনের সর্বজ্ঞ বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।  যদিও আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে কিছু অস্পষ্টতা এবং দুর্বলতা এখনো রয়ে গেছে।  তা সত্ত্বেও বলা যায় আন্তর্জাতিক আইন আইনের সমমর্যাদাসম্পন্ন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকা উচিত নয়।

Read More স্বাধীনতার সংজ্ঞা নিরূপণ করো এবং স্বাধীনতার প্রকারভেদ সম্পর্কে বিষদে আলোচনা করো।

বিঃ দ্রঃ আমাদের আজকের আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত অর্থে আইন বলা যায় কিনা? প্রশ্নটির উত্তর তৈরি করার জন্য কিছু রেফারেন্স বইয়ের সাহায্য নিতে হয়েছে; তাই এই নোটসটি নিয়ে যদি আপনাদের কারো কোনো সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে আমাদের ইমেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়; আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো আপনার সমস্যা দূর করার। আর এভাবেই www.artsschool.in এর পাশে থেকে তোমাদের সাপোর্ট দেখিয়ো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!