খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; আজকে আমরা এই আর্টিকেলে তোমাদের জন্য নিয়ে এসেছি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত তিন বছরের ডিগ্রী কোর্সের প্রথম সেমিস্টারের AECC বাংলার একটি ছোট গল্প ও তার পূর্ণাঙ্গ আলোচনা। যাহা তোমাদের আগামী সেমিস্টার পরীক্ষার জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। তাহলে চলো দেখে নেওয়া যাক খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আলোচনা পর্বটি।
খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কল্যাণী ইউনিভার্সিটি – প্রথম সেমিস্টার
ছোট গল্পকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকাঃ
আজকের বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের ওই জয়জয়কার। ছাদে বৈচিত্র্যে আঙ্গিকে বাংলা ছোটগল্প আজ পৃথিবীর যেকোন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের গল্প রাজির পাশাপাশি স্থান পাওয়ার যোগ্য, যদিও এই ছোট গল্পের গায়ে সাহিত্য পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ লেভেল।
বাংলা ছোটগল্পের উদ্ভব উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে প্রধানত পাশ্চাত্য শিক্ষা ও চিন্তাধারার প্রভাবে। ছোটগল্পের আবির্ভাবের পূর্বে বাঙালি রামায়ণ মহাভারত ও পুরান উপপুরাণ থেকে তো বটেই- লোকগাথা ফারসি গল্প আরব্য উপন্যাসের গল্প এবং হিতোপদেশ ইত্যাদি থেকেও গল্প রস আহরণ করত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য প্রভাব এর ফলে পাঠকদের রুচিতে পরিবর্তন দেখা গেল এবং জাতীয় চিন্তা ধারায় নবজাগরণের প্রভাব কাব্যনাটক এই শুধু নয় কথাসাহিত্যে ও বিস্তৃত হলো। এসময়ে ছোট আকারের কাহিনী নিয়ে পূর্ণ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখলেন মধুমতি আর সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখলেন রামেশ্বরের অদৃষ্ট ও দামিনী। ছোটগল্প এদের বলাও যায় না। বাংলায় সার্থক ছোটগল্প রবীন্দ্রনাথ প্রথম লিখলেন, যদিও গল্পকার হিসেবে তার আবির্ভাবের পূর্বে স্বর্ণকুমারী দেবী ও নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত কয়েকটি ভালো গল্প লিখেছিলেন।
১৩০০ বঙ্গাব্দে ইংরেজি শর্ট স্টোরি অনুকরণে ছোটগল্প নাম দিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়। নামকরণ রবীন্দ্রনাথ নিজেই করেছিলেন, এই সংকলনের গল্পগুলি ইতোপূর্বে হিতবাদী ও সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। হিতবাদী গল্পগুলির সময় রবীন্দ্রনাথ পদ্মা বক্ষে বাস করেছেন; নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় এর মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনকে অতি নিকটে দাঁড়িয়ে দেখেছেন, এরপর দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে আরো বহু ছোট গল্প লিখেন রবীন্দ্রনাথ।
ছোট গল্পের মূল রস করুন। এর সহযোগী প্রধান রস কৌতুক। তার প্রায় প্রতিটি ছোটগল্পে এই কৌতুক রস কম বেশি পরিমাণে আমরা দেখতে পেয়েছি। বিচিত্র তার ছোট গল্পের উপাদান – কখনো লিখেছেন উদ্ভিদ জগতের সঙ্গে মানুষের আদিকালের সম্পর্ক নিয়ে আবার কখনও বিজ্ঞাননির্ভর বিষয়কে ভিত্তি করে সম্পূর্ণ প্রথাবিরুদ্ধ গল্প, কখনো ইতিহাস নির্ভর বিষয়কে ঘিরে, কখনোবা যুদ্ধকে ভিত্তি করে। রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কয়েকটি ছোট গল্প হল পোস্টমাস্টার, কাবুলিওয়ালা, ক্ষুধিত পাষাণ, অতিথি, ছুটি, মেঘ ও রৌদ্র, হালদার গোষ্ঠী ও অপরিচিতা।
রবীন্দ্রনাথ নিজেই শুধু ছোটগল্প লেখেননি, গল্প রচনা আদর্শ সৃষ্টি করে তৎকালীন বাংলার আরো বহু লেখককে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তৈলক্যনাথ মুখোপাধ্যায় ও প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় রসাত্মক গল্প লিখে অদ্ভুত সাফল্য লাভ করেছিলেন। এ যুগের রবীন্দ্র অনুসারী আরো কয়েকজন বিশিষ্ট লেখক হলেন চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ও প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের খ্যাতি মূলত উপন্যাসিক হিসাবে; কিন্তু ছোটগল্পকার হিসেবেও তিনি যখন তার প্রমাণ মেলে মহেশ, অভাগীর স্বর্গ ইত্যাদি গল্পে।
সবদিক মিলিয়ে দেখলে সন্দেহ থাকে না যে, বাংলার ছোটগল্প ভান্ডার বিশেষ সমৃদ্ধ। ছোটগল্পের ভবিষ্যত উজ্জ্বল। বাঙালির বৈচিত্রহীন সীমাবদ্ধ জীবনে উপন্যাসের উপাদানের অভাবে কিন্তু ছোটগল্প এখানকার পরিবেশ ও মানসিকতার সম্পূর্ণ উপযোগী।
খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন গল্পের উৎস ও সময়কালঃ খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন গল্পটি রচিত হয় ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে। এটি গল্পগুচ্ছ প্রথম খন্ডের অন্তর্গত। গল্পটি তিনটি পরিচ্ছেদে রচিত। রায় চরণের জীবনে সাধারণ ঘটনা দিয়ে গল্পটি শুরু হয়েছে এবং গল্পটির সমাপ্তি ঘটেছে একটি অসাধারণ ঘটনার উপস্থাপনার মাধ্যমে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পটির মধ্যে একটি উৎস কৌতূহলবোধ উদ্বৃত্ত হয়। এবং পরিণতিতে একটি অবিশ্বাস্য বিষয়ে কিভাবে মানব মনের অন্তরীণ গভীর রহস্যের সন্ধান দেয় তা বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয়।
খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গল্পের বিষয় সংক্ষেপঃ
12 বছর বয়সের লম্বা চুল ও ছিপছিপে গড়নের বালক রাইচরণ, যশোর জেলা থেকে অনুকূল বাবুদের বাড়িতে কাজ করতে এসেছিলেন। এখন অনুকূল বাবুর মাত্র এক বছর বয়স। তাকে দেখাশোনা করাইছিল রায় চরণের একমাত্র প্রধান কাজ। কাল ক্রমে সেই শিশুপুত্র অনুকূল বাবু স্কুল-কলেজের গণ্ডি অতিক্রম করে কর্মে যোগ দিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে অনুকূল বাবু বিয়ে করেছেন ঘরে নতুন বউ এসেছে, তাদের একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। এখন আর অনুকূল বাবু নন – তার পুত্র সন্তানের দেখাশোনার দায়িত্ব এসে পড়েছে রায় চরণের ওপর।
এই সময় অনুকূল বাবু পদ্মার তীরবর্তী অঞ্চলে বদলি হয়েছেন – তার শিশুপুত্রের জন্য ঠেলা গাড়ি কিনেছেন একটি; এই ঠেলাগাড়ি করে নতুন প্রভুকে বসিয়ে রায়চরন দুবেলা হাওয়া খাওয়ার জন্য নিয়ে যেত পদ্মার ধারে। সাটিনের জামা হাতে সোনার বালা পায়েল পরিয়ে নতুন প্রভুকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার আনন্দ রাইচরণ কত আন্তরিকভাবে অনুভব করে। প্রভুকে সাজিয়েই তার আনন্দ তার এই পেজে কিছুটা খামখেয়ালি তারায় সরল মনে মনে জানে।
বর্ষাকালে একদিন চারিদিকে ক্ষুধিত পর্দার গ্রাসে জলে ডুবে গেছে শস্য ক্ষেত্র, শস্যক্ষেত্র কাশবন ঝাউবন সব। অপরাহ্ন, স্থান পদ্মাতীর আকাশ মেঘ মেদুর অনিচ্ছাসত্ত্বেও পদ্মাপারে আসতে হল ক্ষুদ্র প্রভুর ইচ্ছেতেই – ধীরে ধীরে গাড়ি ঠেলিয়া ধান্য ক্ষেত্রের প্রান্তে নদীর তীরে আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন নির্জন নিস্তব্ধ পদ্মাপারে সূর্য অস্ত যাচ্ছে।
কদম গাছের ফুল দেখে তার প্রতি অস্থির হয়ে উঠল ফুলটি নেওয়ার জন্য; রায়চরন তাকে নানাভাবে ভোলানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু রায় চরণের আতিশয্যে অস্থির হয়ে উঠেছিল, বাধ্য হয়েই রায়চরন কদম ফুল আনতে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে তাকে জলের ধারে যেতে বারণ করেছিল কিন্তু শিশুটি জলের নাম শুনে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জলের ধারে গিয়ে একটা দিনও সংগ্রহ করে মাছের জন্য খেলার আয়োজন করতে লাগলো।
শুধু একটা জব করে শব্দ হলো, কদম ফুল কুড়িয়ে এসে রায়চরন দেখল খোকাবাবু নেই। সারা শরীর হিম হয়ে গেল রায় চরণের গলা ফাটিয়ে খোকাবাবুকে ডেকেও লাভ হল না কোন, কেউ উত্তর দিলো না। নিশীথের ঝড়ো বাতাসের মতো রায়চরন অবিশ্রান্ত খুঁজে ফিরতে লাগলো খোকাবাবুকে।
তারপর উৎকণ্ঠিত জননী পদ্ধতির থেকে রায়চরন কে খুঁজে আনলো, অনুকূল বাবুর স্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন সেকি কেঁদে বলে, জানিনা মা। খোকাবাবু কোথায় তা সে জানে না, কিন্তু খোকাবাবু যে মৃত – এ কথা সে একবারও স্বীকার করছে না।
অনুকূল বাবু তার স্ত্রীর মন থেকে রায় চরণের প্রতি অন্যায় সন্দেহ দূর করতে পারেননি। খোকাবাবু কে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর স্ত্রীর আয় চলনকে উৎকোচের প্রলোভনও দেখিয়েছেন। কপালে আঘাত করে রায়চরন গৃহিণীর সন্দেহ দূর করতে পারল না। সে বিতাড়িত হলো, রায়চরন দেশে ফিরল, বহু বছর পর একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিল। বৃদ্ধ বয়সে কষ্ট নিতে না পেরে দেহ ত্যাগ করল।
প্রথম প্রথম রায়চরন পুত্রকে সহ্য করতে পারত না। রায় চরণের ধ্বনি সেই পুত্রকে মানুষ করেছিল – নাম দিয়েছিল ফেলনা। রায়চরন ভাবলো অনুকূল বাবুর ছেলেই আবার মায়ার টানে তার ঘরে ফিরে এসেছে তাই যথাসম্ভব ছেলেটিকে অনুকূল বাবুর পুত্রের মতোই বড় করতে লাগলো।
এইভাবে 12 বছর কেটে গেল, ছেলেটি পড়াশোনায় ভালো দেখতে শুনতে ভাল হ্রিস্থ পুষ্ট এবং শ্যাম বর্ণ। মেজাজের সৌখিন অসুখী ছাত্রীনিবাসে থেকে পড়াশোনা করত এবং রায়চরন কে কাজের লোক বলেই জানত – কারণ রাইচরণ স্নেহে বাবা এবং সেবায় বৃত্ত ছিল তাছাড়া তাহার আরেকটি দোষ ছিল – সেজে ফেনার বাপ একথা সকলের কাছেই গোপন রেখেছিল।
ছেলেকে মানুষ করার জন্য রায়চরন ছেলেটিকে নিয়ে কলকাতায় এসেছিল এবং বহু কষ্টে একটি চাকরি যোগাড় করে ফেলল নাকে নিয়ে কলকাতাতেই থাকতো। কিন্তু বয়সের ভারে আর পারেনা ফ্যাশন এর অভাব নিয়ে সর্বদায় খুঁতখুঁত করতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় রায়চরন কাজে জবাব দিলো এবং খেলনার কাছ থেকে কিছুদিনের জন্য টাকা-পয়সা দিয়ে জরুরী কাজের অজুহাতে বিদায় নিল।
অনুকূল বাবু মুনসেফ বারাসাতে তখন অবস্থান করছেন। তখনো তার দ্বিতীয় সন্তান হয়নি এবং গৃহিণী তখনো পুত্রশোক বুকে ধরে রেখেছেন। এই সময় একদিন সন্ধ্যায় রায়চরন অনুকূল বাবুর বারাসাতের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। অনুকূল বাবু আগের মতোই তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলেও গৃহিণী কিন্তু করলেন না, তখন রায়চরন জোড়হাত করে অনুকূল বাবুর স্ত্রীকে বলল যে, পদ্মা নয়, আর কেউ নয় সে নিজে অনুকূল বাবুর ছেলে কে চুরি করেছিল এবং সে আরও বললো – আমি আনিয়া দিব- দুদিন পরে সেদিন রবিবার কাছারি নেই। অনুকূল বাবু স্ত্রী পুরুষের সকাল থেকেই হা-পিত্যেশ করে ছেলের পথ চেয়ে বসে আছেন। ঠিক বেলা দশটার সময় ফেলনা কে নিয়ে রায়চরন এসে উপস্থিত হলো। ছেলেটির বেশভূষা আকার-প্রকার বিনীত স্বভাব – সবকিছু দেখে অনুকূল বাবুর স্ত্রীর আর কোনো সন্দেহ রইল না।
এক ধরনের মেকি গাম্ভীর্য বজায় রেখে অনুকূল বাবু রায় চরণের কাছে প্রমাণ চাইলেন, ছেলের প্রমান। সেই রকম কোন প্রমাণ দিতে না পারলেও স্ত্রীর আগ্রহের কথা মাথায় রেখে এবং ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে অনুকূল বাবু ও জানতে পারলেন যে রায় চরণের সঙ্গে ফেলনা সম্পর্ক যতধিক পিতা পুত্রের ততোধিক প্রভু-ভৃত্যের। রায়চরন কেয়ার সে বাড়িতে রাখা হলো না। খেলনা ও উদারভাবে অনুকূল বাবুকে বলল, বাবা উহাকে মাফ করো। বাড়িতে থাকিতে না দাও, উহার মাসিক কিছু টাকা বরাদ্দ করিয়া দাও।
রায়চরন পুত্রের মুখে চোখ বুলিয়ে, সকলকে প্রণাম জানিয়ে জনারণ্যে মিশে গেল। মাসের শেষে অনুকূল বাবুর পাঠানো টাকা কিঞ্চিৎ বৃত্তি রায় চরণের দেশের ঠিকানা থেকে ফিরে এলো, রাইচরণের আর কোন খবরই মিলল না।
আরো পড়ুন – কালাপাহাড় গল্পের সংক্ষিপ্ত বিষয়বস্তু।
বিঃ দ্রঃ আমাদের আর্টস স্কুল ডট ইন এর আজকের খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আলোচনা পর্বটি তৈরি করার জন্য আমাদের কিছু পাঠ্যবই এবং রেফারেন্স বইয়ের সাহায্য নিতে হয়েছে; যদিও এর জন্য আমাদের তরফ থেকে কোনো প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি; তাই আমাদের আজকের এই খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর্টিকেলটি নিয়ে আপনাদের যদি কারো কোন সমস্যা থেকে থাকে; তাহলে আমাদের ইমেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায় আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব আপনার কথা শোনার এবং সমস্যাটা দূর করার। ধন্যবাদ।