বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ; আজকের এই আর্টিকেলে আমরা তোমাদের জন্য উপস্থাপন করছি বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মাধ্যমিক ইতিহাস সিলেবাস এর অন্তর্গত পঞ্চম অধ্যায় তথা বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং তার উত্তর যা কিনা বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ কিভাবে ঘটেছিল? ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারের সম্পর্ক কি? যা তোমাদের আগামী মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্নঃ বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ কিভাবে ঘটেছিল? ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারের সম্পর্ক কি?
সূচনা: 1455 ইউরোপের জোহানেস গুটেনবার্গ ছাপাখানা আবিষ্কার করেন। এর একশত বছর পরে পর্তুগিজ জেসুইটরা খ্রিস্টান ধর্ম সংক্রান্ত উপস্থাপনের জন্য প্রথম ছাপাখানা প্রবর্তন করেন। ছাপাখানা সম্পর্কিত গবেষক গ্রাহাম শ তার বিস্তৃত গবেষণায় উল্লেখ করেছেন যে, ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কলকাতা শহরে ও শহরতলী অঞ্চলে প্রায় চল্লিশটি ছাপাখানা গড়ে উঠেছিল।
বাংলায় ছাপাখানা স্থাপনঃ
১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জেমস অগাস্টাস হিকি প্রথম ছাপাখানা স্থাপন করেন। এই ছাপাখানা থেকে হিকি সাহেব ইংরেজি ভাষায় বেঙ্গল গেজেট নামক প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এছাড়া এই সাহেবের ছাপাখানা থেকে ইংরেজ কোম্পানির দরকারি ও মূল্যবান দলিল, চুক্তিপত্র, চিঠিপত্র এবং সরকারি নানা নির্দেশ নামা ইত্যাদি ছাপা হতো। এরপর থিয়েটার কোম্পানির মালিক বার্নাড মেসেনিক এবং লবণ ব্যবসায়ী পিটার রিভ দুজনে মিলে ইন্ডিয়া গেজেট নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন।
ছাপাখানার বিকাশে সঞ্চলন যোগ্য হরফঃ
চার্লস উইলকিন্স ছিলেন বাংলা মুদ্রণ শিল্পের জনক। তিনি প্রথম ধাতু নির্মিত সঞ্চালন যোগ্য বাংলা মুদ্রাক্ষরের জন্মদাতা। তিনি পঞ্চানন কর্মকার ও জোসেফ শেফার্ড এর সাহায্য নিয়ে নতুন সঞ্চালন যোগ্য বাংলা হরফ তৈরি করেন এবং তৎকালীন গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস এর নির্দেশে হ্যালহেড সাহেবের এ গ্রামার অফ বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রস্তকটি ছাপেন।
ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা সরকারি উদ্যোগঃ
চার্লস উইলকিন্স এর প্রতিষ্টিত ছাপাখানা ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দের শেষে সরকারি ছাপাখানা এ রূপান্তরিত হয়। এই ছাপাখানা থেকে সরকারি উদ্যোগে ক্যালকাটা গেজেট নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ছাপানো হয়। চার্লস উইলকিন্স এর এই ছাপাখানার নামকরণ করা হয়েছিল অনারেবল কোম্পানি প্রেস। এছাড়া আলিপুর জেল প্রেস, মিলিটারি অর্ফান সোসাইটি প্রেস, প্রভৃতি সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

ছাপাখানার বিকাশে বেসরকারি উদ্যোগঃ
ছাপাখানার বিকাশে বেসরকারি উদ্যোগ ছিল যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ইউ এন রায় এন্ড সন্স নামক ছাপাখানাটি ভারতের বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল। ছাপাখানার বিকাশে প্রসেস হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে উপেন্দ্রকিশোর নানা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তার পুত্র সুকুমার রায় মুদ্রণশিল্পে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য এবং চন্দ্র রায় যৌথ উদ্যোগে বাঙালি গেজেটি প্রেস আপিস নামে একটি ছাপাখানা গড়ে তোলেন। শ্রীরামপুর মিশন প্রেস, ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেস, উইলিয়াম কেরির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কাঠের পুরাতন ছাপাখানা, রাজকৃষ্ণ রায়ের বিনা যন্ত্র, বিদ্যাসাগর ও মদন মোহনের প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানা সংস্কৃত যন্ত্র প্রভৃতি ছাপাখানা বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠলেও মুদ্রণশিল্পে জোয়ার সৃষ্টি করেছিল।
ছাপা শিল্পের বিস্তারঃ
কেবলমাত্র কলকাতা শহর ও শহরতলীর অঞ্চলে ছাপাখানা গড়ে উঠেছিল তা নয়, বাংলার বিভিন্ন ছোট বড় শহরে এবং গ্রামে-গঞ্জেও ছাপাখানার বিস্তার ঘটে ছিল। যেমন 24 পরগনার দমদম, বসিরহাট, নৈহাটি, সোনারপুর সহ বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, দার্জিলিং জেলাতেও ছাপাখানার বিস্তার ঘটে ছিল। হুগলি জেলায় শ্রীরামপুর মিশন প্রেস ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কে কেন্দ্র করে হুগলি জেলায় ব্যাপক ভাবে ছাপাখানার বিস্তার ঘটে। যথা- উত্তরপাড়া, চন্দননগর, ভদ্রেশ্বর, বলাগর, তেলেনিপাড়া, বাঁশবেড়িয়া, বালি প্রভৃতি ছোট ছোট শহরে এছাড়া অবিভক্ত বাংলাদেশের রংপুরে এবং ঢাকায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়।
ছাপাখানা সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারের সম্পর্কঃ
বাংলায় শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে ছাপাখানার অবদান অপরিসীম। হয়ে উঠেছিল শিক্ষা বিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে ছাপাখানার সম্পর্ক চিরকাল অবিচ্ছেদ্য। ছাপা বই পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। বলা যায় বাংলার শিক্ষা জগতের ছাপাখানা এক নবযুগের বার্তা বহন করে আনে।
বাংলায় ছাপাখানার বিকাশে পারস্পরিক নির্ভরশীলতাঃ
মুদ্রণ যন্ত্রে ছাপা বই ও শিক্ষার বিস্তার একটি আরেকটির উপর নির্ভরশীল। ছাপা বই না থাকলে শিক্ষার বিস্তার ও চাহিদা থাকে না। আবার শিক্ষার বিস্তার যদি না ঘটে তবে ছাপা বইয়ের কোন প্রয়োজন হয় না। তাই দেখা যায় যে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক থেকে ছাপাখানার যেমন বিস্তার ঘটেছে তেমনি ছাপাখানার ডানায় ভর করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ অবিরাম ঘটে চলেছে।
ছাপা বই শিক্ষা বিস্তারের হাতিয়ারঃ
প্রাচীনকাল থেকে ভূর্জপত্র তালপত্র পুথি ইত্যাদির মাধ্যমে ছাত্র শিক্ষা লাভ করত। এই শিক্ষা তৎকালীন সমাজে স্বল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু মুদ্রণ যন্ত্রের মাধ্যমে ছাপা বই আধুনিক যুগের শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে সাহায্য করে চলেছে। সমাজের সব শ্রেণীর মধ্যে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে ছাপাখানা হল প্রধান হাতিয়ার।
ছাপা বইয়ের সুবিধাঃ
ছাপা বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার প্রসারের সহজ উপায় গুলি হল-
- আগে অতি সহজে পুঁথি পত্র পাওয়া যেত না কিন্ত ছাপা বই খুব সহজেই পাওয়া যায়।
- ছাপা বইয়ের স্পষ্ট লেখা ছাড়া সহজে ও সঠিকভাবে পড়তে লিখতে পারতো। যা পুঁথির বা তালপত্রের হাঁতে লেখার ক্ষেত্রে অসুবিধাজনক ছিল।
- স্কুল লাইব্রেরীতে বাড়িতে রাখা থাকলে ছাত্র-ছাত্রীরা বিনামূল্যে বই সংগ্রহ করে পড়তে পারে।
- একই বিষয়ের বই একসঙ্গে প্রচুর ছাপা সম্ভব হলে মুদ্রায় কম হয় এবং প্রকাশকরা সহজলভ্য মূল্যে ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিক্রি করতে পারে।
- বিভিন্ন বিদ্যালয়ে একই ধরনের পাঠ্যসূচির ছাপা বই ব্যবহার করলে সারা দেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে সমতা বজায় রাখা সম্ভব হয়।
বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ এ শ্রীরামপুর মিশনের ভূমিকাঃ
ছাপা বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারে শ্রীরামপুর মিশন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। শ্রীরামপুর মিশনের প্রচেষ্টায় সংস্কৃত ভাষা থেকে বঙ্গানুবাদ করে মহাভারত, রামায়ণ, বত্রিশ সিংহাসন, হিতোপদেশ, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল প্রভৃতি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এছাড়া বাইবেল বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে ছাপা হয়। ফেলিক্স ক্যারি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান রচনা উন্মুক্ত করেছিলেন। এর ফলে শিক্ষাবিস্তারের পথ হয়ে ওঠে আরো প্রশস্ত এবং সহজ।
বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ এ বিভিন্ন সংস্থার ভূমিকাঃ
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হেয়ার ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি স্থাপন করে ছাত্রদের জন্য ইংরেজি ও নানা ভাষায় প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক রচনা, ছাপা ও স্বল্প মূল্যে বিক্রয় এর ব্যবস্থা করেন। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে ক্যালকাটা ক্রিশ্চান ট্রাস্ট এন্ড বুক সোসাইটি, ১৮২৩ ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটি প্রভৃতি সংস্থা পাঠ্য পুস্তক ছাপা ও যোগান দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আরো পড়ুন – বাংলা তথা ভারতে আধুনিক শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে বিষদে আলোচনা করো আর এই শিক্ষা ব্যবস্থা ভারতীয়দের পক্ষে মঙ্গলজনক ছিল কিনা আলোচনা করো।
বিঃদ্রঃ বাংলা ছাপাখানার বিকাশ কিভাবে ঘটেছিল? ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারের সম্পর্ক কি? – আর্টস স্কুল ডট ইন এর আজকের এই প্রশ্নটির উত্তর তৈরি করার জন্য আমাদের কিছু রেফারেন্স বইয়ের সাহায্য নিতে হয়েছে; যদিও এর জন্য আমাদের তরফ থেকে কোনো প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি; তাই আমাদের আজকের এই বাংলা ছাপাখানার বিকাশ কিভাবে ঘটেছিল? ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারের সম্পর্ক কি? প্রশ্নটির উত্তর টি নিয়ে আপনাদের কারো যদি কোন সমস্যা বা অভিযোগ থেকে থাকে; তাহলে আমাদের ইমেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়. আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব আপনার সমস্যা দূরীকরণে. ধন্যবাদ.